ঢাকায় প্রথম বিদ্যুৎ এর আগমন
ঢাকায় তথা বাংলাদেশে প্রথম বিদ্যুৎ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল বিংশ শতকের প্রথম বছর। আর এর আর্থিক সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন ঢাকার নবাব আহসানউল্লাহ। ৭ই ডিসেম্বর, ১৯০১ সালে প্রথম ঢাকার রাস্তায় বিদ্যুতের বাতি জ্বলে উঠে। এর পূর্বে ১৯০১ সালের জুলাই মাসে ঢাকা পৌরসভা কর্তৃক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে জানানো হয় যে সকল রাস্তায় ও এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে তার নাম। পৌরসভার অধীনে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য "দি ঢাকা ইলেকট্রিক ট্রাস্টিস" নামে পরিষদ গঠন করা হয় এসময়।
স্বাধীনতার পূর্বের ইতিহাস
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকরা চলে যাবার সময় বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থাটি ছিল একেবারে বিচ্ছিন্ন ধরনের, এ সময় কোন দূরবর্তী ট্রান্সমিশন ব্যবস্থা ছিল না। কিছু সুনির্দিষ্ট এলাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদন হত সে সকল এলাকায় ব্যবহারের জন্য। বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হত বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়। এছাড়া কিছু শিল্প (চা, চিনি এবং টেক্সটাইল) এবং রেলওয়ে ওয়ার্কশপে নিজস্ব উৎপাদিত বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হত। অধিকাংশ জেলাগুলিতে শুধুমাত্র রাতের বেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতো। শুধুমাত্র ব্যতিক্রম ছিল ঢাকা শহর যেখানে দুটি ১৫০০ কিলোওয়াটের জেনারেটর দ্বারা বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতো এবং উৎপাদিত বিদ্যুৎ ছিল ৬৬০০ ভোল্টের। পাওয়ার ইউটিলিটি কোম্পানীর কর্তৃক উৎপাদন ক্ষমতা ছিল মাত্র ৭ (সাত) মেগাওয়াট এবং দেশের সর্বমোট উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ২১ মেগাওয়াট।
১৯৪৮ সালে বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিস্থিতির পরিকল্পনা ও উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ অধিদপ্তর তৈরি করা হয়। ১৯৫৯ সালে পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (ওয়াপদা) তৈরি করা হয়। ১৯৬০ সালে, উচ্চতর ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করা হয় সিদ্ধিরগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও খুলনায় (সর্বোচ্চ উচ্চক্ষমতার কেন্দ্রের আকার ছিল সিদ্ধিরগঞ্জে ১০ মেগাওয়াটের স্টিম টারবাইন)। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের আমলে ১৯৫৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ কার্যক্রম শুরু হয় ও ১৯৬২ সালে এটির নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ প্রকল্পে ২টি ৪০ মেগাওয়াটের জেনারেটর স্থাপন করা হয়, যা তৎকালীন সময়ের জন্য একটি বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়। এর পাশাপাশি ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের মধ্যে ১৩২ কেভি ট্রান্সমিশন লাইন স্থাপনের কাজ চলে। কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ এবং ঢাকা-চট্টগ্রামের ট্রান্সমিশন লাইন কমিশনিং এই দেশের বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নের প্রথম মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।১৯৬০ সাল থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা গিয়ে দাঁড়ায় ৮৮ মেগাওয়াট থেকে ৪৭৫ মেগাওয়াট। যার অধিকাংশই উৎপাদিত হত প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেল চালিত জেনারেটর দ্বারা, স্টিম টারবাইন জেনারেটর দ্বারা এবং জল বিদ্যুৎ থেকে।
স্বাধীনতার পর থেকে একবিংশ শতকের শুরুর আগ পর্যন্ত
বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২ সালে বিদ্যুৎ খাতের সার্বিক উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে গতি প্রদান করতে
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড স্থাপন করা হয় এবং পল্লী অঞ্চলের বিদ্যুতায়নকে ত্বরান্বিত করতে ১৯৭৭ সালের অক্টোবর মাসে স্থাপন করা হয় বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড।[৭] বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে সারাদেশে নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন ও বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন সম্প্রসারণের কাজ চলতে থাকে। বিভিন্ন শহর ও নগরীর মধ্যে বৈদ্যুতিক সঞ্চালন লাইনের অন্তঃ সংযোগ করা হয় ২৩০ কিলোভোল্টের ও ১৩২ কিলোভোল্টের ট্রান্সমিশন লাইন দ্বারা। ১৯৮২ সালের ডিসেম্বর মাসে সর্বপ্রথম দেশের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে থাকা বৈদ্যুতিক সঞ্চালন লাইনকে একসাথে সংযুক্ত করা হয়। একটি ডাবল সার্কিট ২৩০ কিলোভোল্ট ট্রান্সমিশন লাইন দ্বারা যমুনা নদীর উপর দিয়ে এই সংযোগ দেয়া হয় যা যুক্ত করে টঙ্গী ও ঈশ্বরদীতে থাকা ১৩২ কেভির ট্রান্সমিশন লাইনকে।১৯৭২ সালের পর থেকে ১৯৯১-৯২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা গিয়ে দাঁড়ায় ২৩৫০ মেগাওয়াট। ১৯৯৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সারাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে দাঁড় করায় ২৮১৮ মেগাওয়াটে। ১৯৮৬ সালের পর থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সামগ্রিক কর্মক্ষমতা ব্যাপক হারে হ্রাস পায়, এ সময় গড় সিস্টেম লস ছিল প্রায় ৪২ শতাংশ, এবং গড়ে বকেয়া বিলের পরিমাণ ছিল প্রায় সাড়ে ৬ মাসের। এর ফলশ্রুতিতে জাতীয় সংসদে " বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত পুনর্গঠন " রিপোর্ট উপস্থাপন করা হয় ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে।
১৯৯০ সাল নাগাদ সারাদেশের মোট বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহারের ৫০ শতাংশ ব্যবহৃত হত রাজধানী ঢাকায় ও এর আশে পাশের এলাকায়। সুষ্ঠুভাবে বৃহত্তর ঢাকার বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণের জন্য ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কাছ থেকে অতিরিক্ত বোঝা কমাতে ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ সরকার ঢাকা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো) তৈরি করা হয়। বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরন ব্যবস্থাকে আরো গতি প্রদান করতে ২১ নভেম্বর, ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড থেকে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরন ব্যবস্থাকে পৃথক করে একটি প্রতিষ্ঠান পাওয়ার গ্রীড কোম্পানী অব বাংলাদেশ তৈরি করে।
১৯৯৬ সালে পাওয়ার গ্রীড কোম্পানী অব বাংলাদেশ দায়িত্ব গ্রহণ করার সময় ২৩০ কিলোভোল্টের ট্রান্সমিশন লাইনের মোট দৈর্ঘ্য ছিল ৮৩৮ সার্কিট কিলোমিটার এবং ১৩২ কিলোভোল্টের ট্রান্সমিশন লাইনের মোট দৈর্ঘ্য ছিল ৪৭৫৫ সার্কিট কিলোমিটার। ২০০১ নাগাদ এটি হয়ে ওঠে ২৩০ কিলোভোল্টের ট্রান্সমিশন লাইনের ক্ষেত্রে ১১৪৪ সার্কিট কিলোমিটার এবং ১৩২ কিলোভোল্টের ট্রান্সমিশন লাইনের ক্ষেত্রে হয়ে ওঠে ৪৯৬২ সার্কিট কিলোমিটার।
একবিংশ শতকের শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত
একবিংশ শতকের শুরুর দিকে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের সার্বিক উন্নয়নের গতি অনেকটাই হ্রাস পায়। সরকারের নীতি নির্ধারক পর্যায়ে সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থতা, দুর্নীতি ও দাতা সংস্থা গুলো থেকে বিনিয়োগের অভাবে[১৩] ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দেশের জাতীয় গ্রীডে যুক্ত হয় মাত্র ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।[১৪] এ সময় প্রতি বছর সারাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি পায় ৪০০ থেকে ৫০০ মেগাওয়াটের মত। ২০০৫ সালের অক্টোবর মাস নাগাদ সারাদেশের লোডশেডিং এর পরিমাণ ছিল প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৯০০ মেগাওয়াট।[১৫] লোডশেডিং এর পরিমাণ ২০০৬ সালের মে মাস নাগাদ নাগাদ ১০০০ মেগাওয়াট অতিক্রম করে এবং এ সময় সান্ধ্যকালীন বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ৪২০০ মেগাওয়াট। সরকারি কর্মকর্তাদের মতে এই লোডশেডিং এর পরিমাণ পরবর্তী বছর নাগাদ ১ হাজার ৬২৪ মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যাবে।[১৩] এ সময় বিদ্যুতের দাবীতে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচাইতে বড় আন্দোলন ঘটেছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাটে, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ গোলাম রব্বানির নেতৃত্বে বিদ্যুতের প্রকট সমস্যা সমাধানে জন্য।[১৬] একই সময় রাজধানীর শনির আখড়ায় হাজার হাজার এলাকাবাসী বিদ্যুৎ ও পানির দাবীতে রাস্তায় নেমে আসে আন্দোলন করতে।[১৭]
২০০৯ সাল নাগাদ বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা এসে দাঁড়ায় ৪৯৪২ মেগাওয়াট আর প্রকৃত সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ৩২৬৮ মেগাওয়াট (৬ই জানুয়ারি, ২০০৯)।[১৮] ২০১০ ও ২০১১ সালে দৈনিক সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৫১৭৪ মেগাওয়াট ও ৪৬৯৮.৫ মেগাওয়াট। ২০১১ সালের জুন মাসে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৪,৬০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়। এর মধ্যে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নিজস্ব উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২৬০০ মেগাওয়াট। অবশিষ্ট ২০০০ মেগাওয়াট বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের মাধ্যমে উৎপাদিত। ২০১২ সালের মার্চ মাসে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা দৈনিক ৮০০৫ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়। পিডিবি ২২ মার্চ, ২০১২ তারিখে রেকর্ড ৬০৬৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে। [১৯] ২০১৭ সালের শেষ নাগাদ উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩,১৭৯ (মার্চ ২০১৭)।[৩] আর প্রকৃত সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৪৭১ মেগাওয়াট (২৭ মে, ২০১৭)।
No comments:
Post a Comment